শিরোনাম |
❒ যশোরসহ সারাদেশে আকাশছোঁয়া দাম
❒ ইলিশেরি বদলে সিলভার কার্প ছবি:
আকাশছোঁয়া দামে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ এখন বিলাসিতা
পান্তা-ইলিশ বাঙালির নববর্ষ উদ্যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুগ যুগ ধরে পহেলা বৈশাখে এই খাবার খেয়ে বর্ষবরণ শোভাযাত্রায় অংশ নেন নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের মানুষ। কিন্তু এবার সেই রীতিতে বাধ সেধেছে ইলিশ। যশোর-খুলনাসহ দেশের সব জেলা থেকে যে তথ্য চিত্র আসছে, তাতে জানা যাচ্ছে ইলিশের তীব্র সংকট বিরাজ করছে সর্বত্রে। অল্প কিছু ইলিশ নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে বিক্রেতাদের। তবে দাম আকাশছোঁয়া। এতো দামে ইলিশ কিনে পান্তা-ইলিশ খাওয়ানোর সামর্থ্য অধিকাংশ মানুষের নেই। রাজনীতি ও সমাজ সচেতন মহল বলছেন এবারের পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ হয়ে উঠছে অনেকের জন্য বিলাসিতা।
আজ রোববার (১৩ এপ্রিল) যশোর বড়বাজারে মাছের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, হাতে-গোনা কিছু দোকানে ইলিশ আছে কিন্তু দাম শুনে খরিদ্দার যেন থমকে দাঁড়াচ্ছেন। কাচো-মাচো মুখ করে অধিকাংশরা ইলিশ না কিনে খালি প্যাকেটে বাড়ি ফিরছেন।
বিক্রেতারা বলছেন ইলিশের সংকট তীব্র হয়েছে। যা দিয়ে আড়ত থেকে কিনছি, তার চেয়ে কেজিতে ২০/৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রির চেষ্টা করছি কিন্তু সকাল ধরে বেচাবিক্রি তেমন হয়নি। আব্দুল নামে এক ভোক্তা বলেন-ইলিশের বদলে সিলভার কার্প কিনেছি। ইলিশ কেনার সামর্থ্য সেই বলে তাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে ইলিশ বিক্রেতা কোরবান আলী জানান-কিছুই করার নেই। বাজারে ইলিশের সরবরাহ নেই। হাতে-গোনা কয়েকটি ইলিশ নিয়ে বসে আছি কিন্তু ক্রেতারা দাম শুনে চলে যাচ্ছেন।
ঢাকা থেকে কিশোর কুমার দে জানান-খোদ রাজধানীতে কেজি ওজনের একটি ইলিশ কিনতে গুনতে হচ্ছে ৩ হাজারের উপরে। রোববার বাজার ঘুরে তিনি এই চিত্র দেখতে পেয়েছেন। তারপর ওজনে ফাঁকির ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন-পটুয়াখালীর আলিপুর ও মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের চিত্র হতাশাজনক। এসব কেন্দ্রে ইলিশের জোগান আশঙ্কাজনকভাবে কম। মাছ ধরার ট্রলারগুলোর বেশিরভাগই খালি হাতে ফিরে আসছে।
মহিপুরের জেলে আবদুল মতিনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদক বলেন, গত এক সপ্তাহে কয়েকবার জেলেরা সাগরে গিয়েছেন কিন্তু তেমন মাছ পাননি বলে দাবি করেছেন। আগে এই সময় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত, এখন একদমই নেই।
জেলেদের অভিযোগ, অনাবৃষ্টির কারণে সাগরে ইলিশের আনাগোনা কমে গেছে। তার ওপর দেশের ৬টি নদীর অভয়াশ্রমে সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞা আরও একধাপ সংকট তৈরি করেছে। মার্চ ও এপ্রিল মাসে ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম থাকায় সরকার প্রতিবছর এই সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখে। এতে নদীতে মাছ ধরা প্রায় বন্ধ থাকায় জেলেরা বেকার সময় পার করছেন।
বরিশাল থেকে শাওন চক্রবর্তী জানান-সাগর থেকে হাতে গোনা কিছু ইলিশ নিয়ে ফিরতে দেখা গেছে জেলেদের। এ সংকটের সরাসরি প্রভাব পড়েছে বাজারে। পাইকারি ও খুচরা দুই বাজারেই ইলিশের দাম ঊর্ধ্বমুখী। মহিপুর ও আলিপুর পাইকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ১ কেজি ওজনের ইলিশ আড়াই হাজার টাকা, দেড় কেজি ওজনের ইলিশ সাড়ে ৩ হাজার টাকা এবং ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকায়। আর খুচরা বাজারে তো দাম আরও অনেক বেশি।
স্থানীয় এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, মৌসুমের শুরুতে যেটুকু মাছ উঠেছিল, তা এখন প্রায় শেষ। পহেলা বৈশাখ সামনে থাকায় চাহিদা অনেক, কিন্তু জোগান নেই। তাই দাম বাড়ছেই।
এদিকে ক্রেতারা পড়েছেন সবচেয়ে বড় বিপাকে। পটুয়াখালী শহরের কাঁচাবাজারে কথা হয় শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া আমাদের পরিবারে একটা আনন্দঘন রীতি। কিন্তু এবারের বাজার দেখে বুঝছি সেটা আর সম্ভব নয়। এত দামে মাছ কেনা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
খুলনা থেকে আমাদের প্রতিবেদক জানান- এ চিত্র শুধু শহরে নয়, জেলার বিভিন্ন হাটেও একই অবস্থা। অনেকেই বাজারে গিয়ে ফিরে আসছেন খালি হাতে। কেউ কেউ ইলিশ ছাড়াই নববর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে এখনই পরিকল্পিত উদ্যোগ দরকার। সঠিক সময়ে নিষেধাজ্ঞা মানা, সচেতনতা বাড়ানো ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা কঠিন হবে। এই সময়টায় ইলিশ সংরক্ষণের জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকাটা প্রয়োজনীয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি ইলিশ উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে প্রভাব পড়তেই পারে।
এদিকে নববর্ষ ঘিরে খাবার হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ক্যাটারিং ব্যবসায়ীরা পড়েছেন সমস্যায়। আগে থেকেই অনেক অর্ডার নেয়া থাকলেও ইলিশের উচ্চমূল্যের কারণে এখন তারা পড়েছেন বিপাকে। কেউ কেউ বিকল্প মেনু তৈরি করছেন।
সব মিলিয়ে এবারের বৈশাখে পান্তা-ইলিশ শুধু রীতির অংশ নয়, তা যেন একটি কল্পনা, একটি স্মৃতি। বাজারে ইলিশ আছে, কিন্তু অধিকাংশের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।