শিরোনাম |
❒ গাড়িচালক হাবিবুর রহমানকে বিদায় সংবর্ধনা
টানা সময় যশোরে যে যখন জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে এসেছেন, তখন তাঁকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন দক্ষ গাড়িচালক হাবিবুর রহমান। সেই চালককে অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার একদিন আগে জানানো হয় বিদায় সংবর্ধনা। এখানেই শেষ না। তাঁকে জেলা প্রশাসকের আসনে বসিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিলেন আজাহারুল ইসলাম। হ্যাঁ এই আজাহারুল ইসলামই যশোরের বর্তমান জেলা প্রশাসক। নজিরবিহীন এ ঘটনা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ার পর প্রশংসায় ভাসছেন জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম। এরআগে এমন দৃষ্টান্ত যশোরের আর কোনো জেলা প্রশাসক স্থাপন করেছে কি-না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মাহির দায়ান আমিন গণমাধ্যমকে জানান, গাড়িচালক হাবিবুর রহমান ১৯৮৫ সাল থেকে জেলা প্রশাসনে কর্মরত ছিলেন। প্রায় চার দশক ধরে তিনি জেলা প্রশাসকের গাড়ি চালিয়েছেন। তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়েছে। এখানেই শেষ না। জেলা প্রশাসক স্যার নিজে ড্রাইভিং করে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছেন বাড়িতে।
আজ বুধবার (১ জানুয়ারি) থেকে শুরু হয়েছে পিআরএল। আগের দিন মঙ্গলবার জেলা প্রশাসন তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানায়। অনুষ্ঠান শেষে জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম তাকে গাড়িতে বসিয়ে শহরের মিশনপাড়ার বাড়িতে পৌঁছে দেন। সাধারণত যে আসনে জেলা প্রশাসক বসেন, সেখানেই হাবিবুর রহমানকে বসিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক স্যার নিজে। এছাড়াও হাবিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের সাথে কুশল বিনিময় করেছেন জেলা প্রশাসক।
এ ঘটনায় আবেগাপ্লুত হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘৪০ বছর ধরে আমি জেলা প্রশাসক স্যারদের গাড়ি চালিয়েছি। বিদায় বেলায় স্যার গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। পরিবার ও প্রতিবেশীদের কাছে আমার সম্মান বেড়েছে।’
হাবিবুর রহমানের বিদায় সংবর্ধনায় দেয়া বক্তব্যে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সততা ও নৈতিক আচরণের প্রশ্নে আপোষহীনতার যে দৃষ্টান্ত জনাব হাবিব স্থাপন করেছেন, তা সত্যিই বিরল।’ জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্যক্তি ও চাকরিজীবনে মো. হাবিবুর রহমানের আদর্শিক অবস্থান অনুসরণ করার আহ্বান জানান তিনি।
সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মাহির দায়ান আমিন বলেন, ২০২২ সালে জেলা পর্যায়ে শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন হাবিবুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একাধিক সূত্রে জানা যায়-সরকারি কর্মকর্তা যাঁদের গাড়ি রয়েছে, তাঁদের গাড়িপ্রতি মাসে ১৮০ লিটার তেল বরাদ্দ থাকে। এই তেলের বেশির ভাগ চালকরা বেচাবিক্রি করে পকেট ভারী করেন বলে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যায়। জেলা প্রশাসকের গাড়িচালক এই ১৮০ লিটারের বাইরেও বিভিন্ন অজুহাতে আরও সমপরিমাণ তেল নেয়ার নজির রয়েছে। কিন্তু হাবিবুর রহমান দীর্ঘ চাকরিজীবনে নিজেকে সততা ও কর্মনিষ্ঠার মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তার তথ্যমতে, হাবিবুর রহমান তাঁর বরাদ্দের তেলেই মাস শেষ করতেন। এ কারণে ২০২২ সালের ২৭ জুলাই যশোরে জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান গাড়িচালক হাবিবুর রহমান। শুদ্ধাচার পুরস্কার তোলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান।
এ বিষয়ে যশোরের সাবেক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামান গণমাধ্যমকে জানান-‘আমার চাকরিজীবনে হাবিবুর রহমানের মতো সৎ মানুষ খুব কমই দেখেছি। অধিকাংশ গাড়িচালকের বিরুদ্ধে তেল চুরির অভিযোগ পাওয়া যায় কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন হাবিবুর রহমান। সরকারি গাড়িতে মাসে ১৮০ লিটার তেল বরাদ্দ থাকে। তিনি যশোরের মতো একটি বড় জেলার জেলা প্রশাসকের গাড়িচালক। ব্যস্ততম জেলা যশোরের ডিসি স্যারকে পুরো জেলায় চলাচল করতে হয়। অথচ তাঁর গাড়িতে যা তেল লাগে, এটা অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য।’
কাজী সায়েমুজ্জামান আরও বলেন, ‘তিনি যতটুকু তেল লাগে ততটুকুই নেন। হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়েছে। শুনে মনটা কিছুটা খারাপ। সততার উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাঁর উদাহরণ টানি। গাড়িচালকদের ট্রেনিংয়ে সততার উদাহরণ দেখাতে হাবিবুর রহমানকে নিয়ে যাওয়া উচিত। তিনি সরকারি গাড়িচালকদের সততার দৃষ্টান্ত।’