শিরোনাম |
❒ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মগোপন
ব্যাংকের বোর্ড সভায় সশরীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করায় বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকের পদ হারাতে যাচ্ছেন অন্তত ৬০ জন। কারণ, তাঁরা সশরীর সভায় যোগ দিচ্ছেন না। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে বেসরকারি ২৮ ব্যাংকের এই পরিচালকেরা আত্মগোপনে বা বিদেশে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র বলেছে, সভায় যোগ না দেওয়া এই পরিচালকদের বাদ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে নিয়ম অনুযায়ী তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। তবে যেসব ব্যাংকে বিদেশি শেয়ারহোল্ডার পরিচালক রয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রাষ্ট্রায়ত্তসহ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন এসেছে। কয়েকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ছোট আকারে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তবে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন অনুযায়ী একটি ব্যাংকে সর্বোচ্চ ২০ জন পরিচালক নিয়োগ করা যাবে। আর স্বতন্ত্র পরিচালক হবেন অনধিক তিনজন।
ব্যাংকগুলোর হাইব্রিড মিটিং (ভার্চুয়াল সভা) বাতিলের নির্দেশনা দিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই নির্দেশনা মেনে এরপর থেকে পরিচালকদের সশরীর উপস্থিতিতে বোর্ড সভা হচ্ছে। সূত্র বলেছে, বেসরকারি খাতের ২৮টি ব্যাংকের কমপক্ষে ৬০ জন পরিচালক সভায় থাকছেন না। তাঁদের সভায় উপস্থিত হতে ব্যাংকগুলো জানিয়েছে। কিন্তু জবাবে তাঁরা সভায় থাকতে না পারার কথা জানিয়েছেন। এই পরিচালকেরা বর্তমানে আত্মগোপনে বা বিদেশে আছেন।
জানতে চাইলে গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা আজকের পত্রিকাকে বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বোর্ডের ভার্চুয়াল সভা বাতিল করেছে। সেই নীতি অনুযায়ী বোর্ড সভায় উপস্থিত না থাকলে পরিচালক থাকার বিষয়ে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে সরাসরি উপস্থিতির প্রজ্ঞাপনের পর যেসব ব্যাংকে বিদেশি শেয়ারহোল্ডার পরিচালক রয়েছেন, সেসব ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যাবতীয় প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে বিদেশি শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের অনুপস্থিতির কারণে আপাতত বাদ দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু ব্যাংকের দেশীয় পরিচালকেরা বোর্ড সভায় উপস্থিত না থাকলে তাঁদের ছাড় দেওয়া হবে না।
ব্যাংকগুলোর হাইব্রিড মিটিং বাতিলের নির্দেশনার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২৪ সেপ্টেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ থেকে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও (এনবিএফআই) হাইব্রিড মিটিং বাতিল করে প্রজ্ঞাপন দেয়। অর্থাৎ এখন থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভায় পরিচালকদের সশরীর উপস্থিত থাকতে হবে। ২০২৩ সালের ১৫ মে সার্কুলারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য হাইব্রিড মিটিং অনুষ্ঠানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আজ সোমবার তাঁদের ব্যাংকের পর্ষদ সভা। সব পরিচালককে বিষয়টি অবহিত করা হলে তিনজন পরিচালক জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা সভায় সশরীর থাকবেন না। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর তাঁরা আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁরা ব্যাংকটিকে ধ্বংসের চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকেও একই অবস্থা বলে জানিয়েছেন সেগুলোর এমডিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের মদদপুষ্টরা নানা কৌশলে ব্যাংকে পরিচালক হয়েছেন। তাঁরা যোগসাজশে ব্যাংক খাতে ঋণের নামে ডাকাতি করেছেন। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত থেকে পরিচালকদের ঋণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
অবশ্য মোট সাড়ে ১৫ লাখ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে অনাদায়ি প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা। মূলত সরকারের মদদপুষ্ট চেয়ারম্যান এবং পরিচালকদের কারণে ব্যাংকের অর্থ হরিলুট হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৫ বছরে মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৫টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০২৩ সালে সুশাসন নিশ্চিতে ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের নিয়ম কঠোর করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে অনুযায়ী কোনো ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক হওয়ার জন্য বয়স হতে হবে সর্বনিম্ন ৩০ বছর। একই সঙ্গে পরিচালক হতে হলে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এর আগে এমন নিয়ম না থাকার সুযোগে অনেক ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ পান আওয়ামী লীগপন্থীরা।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংকগুলো থেকে সরকারঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালীরা চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে শুরু করেন। সর্বশেষ তথ্যমতে, আলোচিতদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসানুল আলম, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, ইউসিবির চেয়ারম্যান সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামান, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম, সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির, এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত, রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী সানাউল হক।